দুই মাসের ব্যবধানে দুবার দখল হলো রাজধানীর শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দুই মাস আগে আওয়ামী চিকিৎসক পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি দখলচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। তখন স্বাচিপ সভাপতি অর্ধশত বহিরাগত নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন এবং নিজেকে ট্রাস্টের সেক্রেটারি দাবি করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুতের পর ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি ফের দখলের অভিযোগ ওঠে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২ অমান্য করে এক আদেশে ড্যাব সমর্থিত ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাসকে কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। ওই আদেশের পর তিনি মেডিকেল কলেজটি নিজের কবজায় নেন। তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ডা. জাহাঙ্গীর আলমেরও যোগসাজশ রয়েছে। প্রতিকার চেয়ে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া আইন অমান্য করে ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাসকে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনোনীত করায় উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা করা হয়েছে। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত একটি রুলও জারি করেন।
প্রতিকার চেয়ে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্টের পক্ষ থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাঠানো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের কাছে পাঠানো অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটটি স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় অবস্থান করছে। চলতি বছরের গত ৫ আগস্টের পর থেকেই ড্যাব সমর্থিত চিকিৎসক ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে কিছু শিক্ষক ও বহিরাগতকে নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য মেডিকেল কলেজটিকে বেআইনিভাবে দখল করা। এর আগে ২০০২ সালে বিএনপি
নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠানটির দখল নেন। ওই সময় তিনি সাত বছর মেডিকেল কলেজটি নিজের দখলে রাখেন এবং ব্যাপক অর্থ লুটপাট করেন। ২০০৯ সালে মেডিকেল কলেজটি ২০ কোটির বেশি টাকা ঋণে জর্জরিত হয়। তখন ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস পদত্যাগ করে চলে যান। মূল উদ্যোক্তা শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট এরপর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিষ্ঠা, সততা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে কলেজটির একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, হাসপাতালের সেবা সার্ভিস এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে উৎকর্ষের শিখরে নিয়ে যায়। এ সময় ২০ কোটির বেশি টাকার ঋণও পরিশোধ করে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট। কলেজ ও হাসপাতালের কলেবর বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান সঞ্চয় ২৬ কোটি টাকার বেশি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস ও কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ডা. জাহাঙ্গীর আলম কলেজ এবং হাসপাতালটিকে দখলে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন। অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং একদফা দাবিতে সরকার পতনের আন্দোলনের সময় এই অধ্যক্ষ পালিয়ে যান। এ সময় কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক, চিকিৎসকরা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে অধ্যক্ষের অপসারণও দাবি করেন। তখন নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়। এর পর থেকেই কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জাহাঙ্গীর আলম ট্রাস্টি বোর্ডকে অচল করে দিয়ে ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাসকে নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি দখলে মরিয়ো হয়ে ওঠেন।
চিঠিতে বলা হয়, গত ১২ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম এবং ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে একটি গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান লাইলা আরঝুমানের মনোনয়ন বাতিল এবং বাকি সময়ের জন্য ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাসকে গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আদেশ জারি করান। অথচ ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২ অনুসরণ করে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান লাইলা আরঝুমানকে গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান করে তিন বছর মেয়াদি একটি গভর্নিং বোর্ড গঠন করে দেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন ২০২২-এর ১৮/২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান এবং ৫০ শতাংশ গভর্নিং বোর্ডের সদস্য উদ্যোক্তা থেকে নির্বাচিত হবেন। এই আইনের ধারাকে অমান্য করে দখলদার চক্র থেকে প্রভাবিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদেশ জারি করে। ঢাবির আদেশ নিয়ে ডা. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস এবং অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলমরা গত ১৪ সেপ্টেম্বর তিন শতাধিক বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে কলেজটি দখল করেন। এমনকি ট্রাস্টি বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলোকে অন্যায়ভাবে জব্দ করেন। দখলের পর থেকে তারা কলেজ ও হাসপাতালের ২৬ কোটি টাকার সঞ্চিত অর্থ কীভাবে ভাগ-বাটোয়ারা এবং অধ্যক্ষ ডা. জাহাঙ্গীরের পুরস্কার হিসেবে অর্থের বাইরে তার মেয়াদকাল বাড়ানোর দর কষাকষি করছেন। যদিও আগামী ১৩ নভেম্বর এ ডা. জাহাঙ্গীরের অবসরে যাওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে প্রতিষ্ঠানটি অন্যায়ভাবে দখল করেছে এই চক্র। এতে প্রতিষ্ঠানের আট শতাধিক শিক্ষার্থী-শিক্ষক, চিকিৎসক এবং কর্মচারী এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ বিষয়ে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট আইনের আশ্রয় নিয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিকার চেয়েছেন তারা।
অভিযোগের বিষয়ে ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, মেডিকেল কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। তারা একটি আদেশে আমাকে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনোনীত করেছে। এরপর আমি প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়েছি। এখানে অন্যায়ভাবে দখলের তো কিছু করিনি।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২-এর ১৮/২ ধারায় বলা আছে, উদ্যোক্তা থেকে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনোনীত করতে হবে। তাহলে আপনি কীভাবে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারা এই আইনের বাইরেও নিজেদের একটি স্বতন্ত্র আইনে পরিচালিত হয়। সেখানে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মনোনয়নে উদ্যোক্তা হতে হবে, এমন কোনো শর্ত নেই। তার চেয়ে বড় কথা, আমি বেআইনিভাবে কিছু করিনি।
ডা. মোসাদ্দেক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে মনোনীত করেছে, সেই চিঠি নিয়েই আমি কলেজে গিয়েছি। একটি অডিট ফার্মকে নিরীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছি।
এর আগেও প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব নিয়ে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর তো ট্রাস্টের প্রত্যেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর ছিলেন। আমি অর্থ আত্মসাৎ করে থাকলে গত ১৫ বছরে কেন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমানের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।