যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের শেষ সময়ে ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলো চষে বেড়িয়েছিলেন দুই প্রার্থী- ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমালা হ্যারিস। নির্বাচন নিয়ে করা জরিপগুলো দুই প্রার্থীর মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের আভাসও দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি স্টেটে একসঙ্গে ভোট হলেও মূলত সবারই নজর থাকে সুইং স্টেটের দিকে। বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যেই কে এগিয়ে, সেটি সমর্থনের ভিত্তিতে ও জরিপের মাধ্যম আগেভাগে ধারণা করা যায়। কিন্তু সুইং স্টেটগুলোতে তা অনুমান করা কঠিন। হোয়াইট হাউসে জয়ী হওয়ার জন্য কে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পাবে- তা নির্ধারণ করবে এই সাতটি সুইং স্টেট। এই স্টেটগুলোর মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট সংখ্যা ৯৩। সাতটি স্টেটকে সুইং বলা হচ্ছে। সেগুলো হলো অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন।
‘সুইং স্টেট’ — যেগুলো সাধারণত কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে থাকে না, বরং এই নির্বাচনে যেকোনও দিকে যেতে পারে। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের প্রচারণায় এই সাতটি অঙ্গরাজ্যে বিশেষভাবে মনোযোগ দিচ্ছেন। এই রাজ্যগুলো হলো: অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন। এখানে কয়েকটি ভোটের ব্যবধানই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে।
অ্যারিজোনা
মেক্সিকো সীমান্তবর্তী অ্যারিজোনা রাজ্যে। অ্যারিজোনার ভোটারদের এক–তৃতীয়াংশ হিস্পানিক। এই রাজ্যে ইলেকটোরাল ভোট ১১টি। গতবার এই রাজ্যে বাইডেন জিতেছিলেন। ডাকযোগে বা মেইলে ভোট দেওয়া অ্যারিজোনায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০২০ সালে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটার ভাট দিয়েছিলেন মেইলের মাধ্যমে। অ্যারিজোনায় ডাকযোগে বা মেইলে এত এত পরিমাণ ভোট দেয়, যার ফলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ব্যালট গ্রহণের শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পরও গণনা শুরু করতে পারে না। কারণ ব্যালটে নির্বাচন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত মেইলের হিসাব শুরু করা যাবে না। এছাড়াও রাজ্যেটির বৃহত্তম ম্যারিকোপা কাউন্টির সমস্ত ব্যালটের এক-পঞ্চমাংশ মেইলের মাধ্যমে আসে। তাই ব্যালট গণনা করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে৷
জর্জিয়া
১৯৯২ সালের পর গত নির্বাচনেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে জর্জিয়ায় জয় পেয়েছিলেন জো বাইডেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। এই অঙ্গরাজ্যের ৩৩ শতাংশ ভোটার কৃষ্ণাঙ্গ। ২০২০ সালের নির্বাচনের সময় এই রাজ্যের নির্বাচনের ফল পাল্টানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। যার বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে।
এই রাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ১৬টি। নির্বাচনের শুরুতে ব্যক্তিগত ভোটদানে জর্জিয়াতে জনপ্রিয়। স্টেটটির নির্বাচনী কর্মকর্তারা আশা করছেন, ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যালট শুরুতে প্রদান করেবে ভোটাররা। এছাড়াও মেইল বা ডাকে প্রায় ৫ শতাংশ ভোটে প্রদান করা হতে পারে।
এদিকে স্বাক্ষর যাচাইকরণের মতো পদক্ষেপ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে শুরু হয়। যদিও গণনা শুরু করার জন্য নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন কর্মকর্তাদের।
আবার এই স্টেটে বিদেশী এবং সামরিক ভোটাররা ৫ নভেম্বরের মধ্যে পোস্টমার্ক করলে নির্বাচনের তিনদিন পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। এই ধরনের ২১ হাজারেও বেশি ব্যালটের অনুরোধ করা হয়েছিল। তাই এই ভোটগুলি গণনা না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল সমাধান নাও হতে পারে।
মিশিগান
ফোর্ড, জেনারেল মোটরস ও ক্রাইসলামের মতো গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা মিশিগান। গত নির্বাচনে বাইডেন এই রাজ্যে জয়লাভ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি রুখতে বিপুল পরিমাণ করারোপ করেন। রাজ্যের ভোটারদের উল্লেখযোগ্য অংশ আরব–আমেরিকান। এবার গাজা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে তাদের সমর্থন আদায়ের চ্যালেঞ্জ কমলা হ্যারিসের সামনে। এই রাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ১৫টি। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর থেকে মিশিগানে প্রথমবারের মতো ব্যক্তিগত ভোট প্রদান শুরু করেছে। নির্বাচনের আটদিন আগে ৫ হাজাররেও বেশি মানুষ মেইলে ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনি কর্মকর্তারা আশা করছেন, রাজ্যটি ২০২০ সালের তুলনায় আরও দ্রুত ফলাফল প্রদান করতে পারবে।
নেভাদা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী রাজ্য নেভাদা। রাজ্যটি অভিবাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। এখানকার জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ হিস্পানিক। রাজ্যটি অতিমাত্রায় পর্যটননির্ভর। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্য সুইং স্টেটের মধ্যে নেভাদার অর্থনীতিই সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। একই সঙ্গে সব রাজ্যের মধ্যে নেভাদাতে বেকারত্বের হারও সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের নির্বাচনে নেভাদায় জয়ে পেয়েছিলেন বাইডেন। এখানে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ৬টি। ২০২০ সালে নেভাদার ধীর ভোট গণনার কারণে নির্বাচনের পাঁচ দিনপরও নিউজ আউটলেটগুলি ফলাফর প্রকাশ করতে পারেনি। রাজ্যটিতে মেইল ভোটিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটিই একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র, যা দেরিতে পৌঁছানো মেইল ব্যালট গ্রহণ করে।
নর্থ ক্যারোলিনা
সুইং স্টেটের তালিকায় নবীনতম রাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনা। গত জুলাইয়ে বাইডেন সরে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত, ট্রাম্প সেখানে এগিয়ে ছিলেন। যদিও পরে কমলা হ্যারিস সেই ব্যবধান কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। গত ১১টি নির্বাচনে এখান থেকে মাত্র একবার জিতেছেন ডেমোক্র্যাটরা। গত তিন দশকে এখানকার জনসংখ্যায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শ্বেতাঙ্গদের হার ৭৫ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২০ সালে ১৬টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে রাজ্যটিতে জয়ী হন ট্রাম্প। নির্বাচনে ফলাফলের ইঙ্গিত অনুযায়ী দুই দলের ভোট কাছাকাছি হয়, তাহলে উত্তর ক্যারোলিনার ফলাফল এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে অস্পষ্ট থাকতে পারে। ৫ নভেম্বরে ব্যালট, সেইসঙ্গে বিদেশী এবং সামরিক ভোটারদের ব্যালটগুলি নির্বাচনের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে গণনা করা হবে।
পেনসিলভানিয়া
অন্য রাজ্যের তুলনায় পেনসিলভানিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপ বেশি। প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনে ফ্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহারের পর টেক্সাসের পর এটি সবচেয়ে বড় উৎপাদানকারী রাজ্যে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্পের অবস্থান ফ্র্যাকিংয়ের পক্ষে। কমলা শুরুতে এর বিপক্ষে থাকলেও এখন বিকল্প ব্যবস্থায় খোলা রাখার পক্ষে। ১০ সেপ্টেম্বর এই রাজ্যে বিতর্কে মুখোমুখি হন ট্র্যাম্প–কমলা। এখানে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ১৯টি। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র পেনসিলভানিয়া। রাজ্যটি ২০২০ সালে নির্বাচনের দিন তেকে পরের চারদিন ধরে কোনো স্পষ্ট বিজয়ী ছিল না। কারণ কর্মকর্তারা মেইলব্যালটের একটি বিশাল ব্যাকলগ দিয়েছিলেন।
উইসকনসিন
গত দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়া অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল উইসকনসিন। প্রতিবারই মাত্র ২৫ হাজারের কম ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট বেছে নিয়েছেন এখানকার ভোটাররা। এখানকার প্রতিটি ভোটই তাই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ১০। ২০২০ সালে সামান্য ব্যবধানে এই অঙ্গরাজ্যে জিতেছিলেন ট্রাম্প। পেনসিলভানিয়ার মতো উইসকনসিন এমন কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে, যেগুলি নির্বাচনের সকাল পর্যন্ত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মেল ব্যালটগুলি প্রক্রিয়াকরণ বা গণনা করার অনুমতি দেয় না। যার ফলে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করতে দেরী হয়।