হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যা বললেন মাহমুদুর রহমান

জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রথম দিন চার ঘণ্টা সাক্ষ্য দেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। আগামীকাল (মঙ্গলবার) তিনি আবারও সাক্ষ্য দেবেন। সাক্ষ্য শেষে জেরাও হবে।

সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর ১.৩০ মিনিট থেকে ২.৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি দিয়ে আবার চলে তার সাক্ষ্যগ্রহণ। শেষ হয় বিকেল ৪টায়।

মাহমুদুর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণটি হুবহু পাঠকের জন্য তুলে দেওয়া হলো

ড. মাহমুদুর রহমান। আমি একজন লেখক, ইতিহাস গবেষক এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। মহান জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার জন্য শুকরিয়া জানাই। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক হিসেবে এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, বিকাশ এবং পতন প্রত্যক্ষ করেছি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্লানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিলো। সেই প্লানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সংগে একটি বিদেশী শক্তি জড়িত ছিলো। আমি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মিস্টার প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীমূলক বই The Coalition Years থেকে উদ্ধৃত করে মাননীয় ট্রাইব্যুনালকে জানাতে চাই যে, তিনি ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের সাথে দিল্লীতে তার যে কথোপকথন হয়েছিলো তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মঈন ইউ আহমেদের সাথে তার চুক্তি হয়েছিলো যে, যদি শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় তাহলে তৎকালীন সেনা প্রধান তার চাকুরীর নিশ্চয়তা পাবেন, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং সেফ এক্সিট পাবেন। এই মিটিংটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। আমাদের সকলের মনে আছে যে, নির্বাচন হয়েছিলো ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে। তার অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই নির্বাচনের ফলাফল দিল্লীতে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছিলো। নির্বাচনে এই ফল হওয়ার পিছনে জেনারেল মঈন এবং ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো। ডিজিএফআইয়ে সেই সময় কর্মরত ছিলো ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ যিনি পরবর্তীতে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করেছিলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আবশ্যক। কারণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে তাহলে তারা কোন অবস্থাতেই একটি বিদেশী শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোন পুতুল সরকারকে মেনে নিবে না। সুতরাং পরিকল্পনা মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিলো। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ধানমন্ডির এমপি শেখ তাপস সরাসরি জড়িত ছিলো। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সাথে ষড়যন্ত্র করে শেখ তাপস এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিডিআর হত্যাকান্ডের পরিস্থিতি তৈরী করে।

দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিডিআর হত্যাকান্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। বিডিআর হত্যাকান্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। তাদের পরিবারের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। তৎকালীন সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ সেনা সদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করবার কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই বরং দুই দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি একধরনের ঘৃণা ছিলো। এই প্রসংগে আমি আরেকটি বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করবো। বইটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার মিস্টার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটির নাম The Jamdani Revolution. এই বইতে তিনি ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেই সময় শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারতীয় হাইকমিশনার বিদায়ী সাক্ষাতকার করতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় বিদ্রোহে এক দলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়েছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিলো সর্বপ্রথম নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্যে একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের উপরে অত্যাচার চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, ভারত যেন বলে তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোন প্রশিক্ষণ কিংবা অন্য কোন সহায়তা দিচ্ছে না। ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার এই জাতীয় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যে হতবাক হয়ে যান। তিনি শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারত এই জাতীয় কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি এ কথা বিশ্বাস করবে? শেখ হাসিনা আবারো হাই কমিশনারকে একই কথা বলেন। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার এই যে সেনাবাহিনী বিদ্বেষ এটা বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয়েছিলো। সেই সময় সেনাবাহিনীর একাংশ যারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের Regime. প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনা বিদ্বেষ ছিলো। আমি আরো একটি বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। বইটির নামা The Legacy of Blood. লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস। এই সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী সৃষ্টি করতে চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্পরূপে তিনি রক্ষী বাহিনী তৈরী করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই রক্ষী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনা বিদ্বেষের কারনে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড ও মোরাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যাক। বিডিআর হত্যাকান্ড পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমানিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করবার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রনে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্যে শেখ হাসিনা সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রনের দিকে মনোনিবেশ করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে এটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপিড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হলে আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা” শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিলো জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করনের বিরুদ্ধে সতর্ক করা। আমি লিখেছিলাম, বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকলে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র কিছুই থাকবে না। এই লেখার জন্যে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া হয় এবং আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি ঐ সময়কার আদালতের দুইটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে মাননীয় ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি করা হয়েছিলো আদালতকে ব্যবহার করে। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, তিনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ক্ষমতায় এলে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল। এই মামলা নিয়ে তৎকালীন সুপ্রীম কোর্ট যতদূর মনে পড়ে ৮ জন এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন।

এমিকাস কিউরিদের মধ্যে শুধুমাত্র আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধানে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। আপীল বিভাগের ৭ জন মাননীয় বিচারপতিদের মধ্যেও ৩ জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। যে ৪ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন তারা হলেন বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। উল্লেখ্য যে, এই ৪ জন বিচারপতিকেই তাদের সিনিয়রদের সুপারসিড করে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। অর্থ্যাৎ সরকারের প্রতি আজ্ঞাবহ মাননীয় বিচারপতিদের পুরষ্কৃত করবার নীতি গ্রহণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করবার পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এই লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবীর পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগীতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, সকল ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগনের মধ্যে উন্মাদনাসৃষ্টির জন্য একটা পাবলিক এনিমি কনসেপ্ট (গনশত্রু) তৈরী করে। হিটলারের জার্মানীতে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরবর্তীতে ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের এইভাবেই গনশত্রু হিসেবে অভিহিত করে তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের প্রেক্ষাপট তৈরী করা হয়েছিলো। বাংলাদেশেও একইভাবে ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণীকে নির্মূল করার পক্ষে জনমত তৈরী করার জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাড়িয়ে ঘোষণা করেন যে, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন। এমনকি ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন যে, প্রটোকলে না আটকালে তিনি নিজেও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতেন। এর মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজেমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিলো। শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে বেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে কাদের মোল্লার যাবৎজীবন কারাদন্ডের সাজাকে আপীল

বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফাঁসির দাবি করার বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাগণ বাংলাদেশের যেসমস্ত মিডিয়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানায়। তাদের ন্যায় বিচার না করে ফাঁসির দাবি এবং ভিন্ন মতের প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবির মধ্য দিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিবাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়। সেই সময় আমার দেশ পত্রিকা জনগণকে এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমরা একটি সংবাদ প্রকাশ করি যার শিরোনাম ছিলো “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি” এই সংবাদ প্রকাশ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। কিন্তু সরকার অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয় এবং এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে গ্রেফতার করা হয়। শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়লে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়।

২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে সারাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ আলেম এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকায় এসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে। আমার দেখা মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণ জমায়েত সেদিন ঢাকায় হয়েছিলো। ঐ দিন তারা কতগুলো দাবিদাওয়া সম্বলিত একটি আল্টিমেটাম দেয়। দাবিদাওয়াগুলো পূরণ না হওয়ায় মে মাসের ৫ তারিখে তারা আবার ঢাকায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই দিন মধ্য রাতে মতিঝিল শাপলা চত্তরে তাদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ডিএমপির কমিশনার বেনজীর আহম্মেদ, র‍্যাবের অপারেশন চীফ সে সময়কার কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহম্মেদ। গণহত্যার পরের দিন এই তিনজন সংবাদ সম্মেলন করে হেফাযতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করবার ঘোষণা দেন। সেই গণহত্যার পুরস্কার স্বরূপ বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং আজিজ আহম্মেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হয়। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, আজ পর্যন্ত শাপলা গণহত্যার বিচার বাংলাদেশে হয় নাই। শাপলা গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময়কার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচার চলছিলো। ট্রাইব্যুনাল-১ এর মাননীয় চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করছিলেন তার একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট আমার দেশ এবং লন্ডনের দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক তার বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে অবস্থানর একজন বাংলাদেশী জিয়া উদ্দিন আহম্মেদের সাথে নিয়মিত সলাপরামর্শ করতেন। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ এবং ইমেইল আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্ট পত্রিকার হাতে পৌছায়। সেই স্কাইপ কথোপকথনে দেখা যায় যে, পুরো বিচার প্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিনত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক, বেলজিয়ামে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ এবং ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করছেন। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। বিচারপতি নিজামুল হক সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুমকে আগে থেকে বলতেন যে, বিচার চলাকালে তিনি যেন মাঝে মধ্যেই দাড়িয়ে অবজেকশন জানান এবং বিচারপতি নিজামুল হক তাকে বসিয়ে দিবেন। ভাষাটা এরকম ছিলো “আপনি দাড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু, সবাই মনে করবে যে আমাদের খাতির নাই”। নিজামুল হক সাহেব আরেক বার তৎকালীন আপীল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার কাছে পদোন্নতির জন্য তদবীর করছিলেন। উত্তরে বিচারপতি এসকে সিনহা তাকে বলছিলেন, পদোন্নতির আগে তাকে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে।

তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং আইন প্রতিমন্ত্রীর সাথেও বিচারপতি এসকে সিনহা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইলে যেসমস্ত নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিলো তাতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিলো যে, এই মামলাগুলোর রায় পূর্ব নির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিলো। স্কাইপ কেলেংকারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্টে প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। আশ্চর্যের বিষয় শান্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাকে পুরষ্কৃত করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেওয়া হয়। তারপর তাকে পদোন্নতি দিয়ে আপীল বিভাগে নেওয়া হয় এবং বিচারপতির চাকুরী থেকে অবসরের পরেও তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। অর্থ্যাৎ ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে। স্কাইপ কেলেংকারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা পাঁচ দিনে পাঁচটি পর্ব প্রকাশ করতে পেরেছিলো। এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারনে এই সংক্রান্ত সংবাদ আর ছাপানো সম্ভব হয়নি। আমার দেশ পত্রিকা এই ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করার ফলে আমার বিরুদ্ধে আইসিটি (তথ্য ও প্রযুক্তি আইন) আইনের ৫৭ এবং ৫৮ ধারায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ এই ধরণের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশংসিত হয় এবং আইনসঙ্গত বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটার গেইট কেলেংকারির কথা উল্লেখ করা যায়। যে দুজন সাংবাদিক ওয়াটার গেইট কেলেংকারি উন্মোচন করেছিলেন, তাদেরকে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয় এবং সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। ২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে নিতে সমর্থ হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সরকারি নিপীড়ণ আরম্ভ হয়। কাদের মোল্লাকে ততদিনে তিনি ফাঁসি দিতে সক্ষম হন। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে, একতরফা নির্বাচন হলে তিনি সামাল দিতে পারবেন এবং এর পরে বাংলাদেশে তিন তিনটি নির্বাচনী তামাশা মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং তৃতীয়টি ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে। ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কোনরকম ভোট প্রদানের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। অর্থ্যাৎ নির্ধারিত ভোটের দিনের আগেই প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা পূনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই প্রকৃতপক্ষে ভোটদান সমাপ্ত করা হয়েছিলো। ২০১৮ সালের রাতের ভোট প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদুত এই দেশ থেকে তার বিদায়ের আগে সাংবাদিকদের বলে গিয়েছিলেন যে, পৃথিবীতে কোথাও ভোটের আগের রাতে ভোট প্রদান সমাপ্ত হয়ে যায় এটা বাংলাদেশেই প্রথম দেখলাম। ২০২৪ সালে আবারো অনেকটা ২০১৪ সালের মতো একতরফা ভোটবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেই নির্বাচনটি “আমি ও ডামির ভোট” হিসেবে কুখ্যাত হয়েছিলো। কিভাবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সব ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তিনি এবং তার সরকার বিচারবহিঃর্ভূত হত্যাকান্ড করেছে, গুম করেছে, হেফাযতে নির্যাতন করেছে এবং আয়নাঘর বানিয়েছে। ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে র‍্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে প্রথমে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তারপর আইন বহিঃর্ভূতভাবে আদালতের কোন নির্দেশ ছাড়াই ডিবি থেকে আমাকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তারপর অন্ধকার সেলে নিয়ে আমাকে গারদের শিকের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিলো। টিএফআই সেলে আমাকে শারিরীক নির্যাতন করা না হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিলো। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমি পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের এক একজনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো। সেখানে অধিকাংশরাই আলেমা শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। হয়তো মানসিক টর্চার করবার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়েছিলো। আমি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়েছিলাম।

যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত এবং নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাংগানো ছিলো। এখানে আমাকে এক দিন রাখা হয়েছিলো। আমাকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে রাত্রী ১.০০টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দিয়ে ৫/৬ জন আততায়ী আমার সেলে প্রবেশ করে আমাকে বিবস্ত্র করে। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিলো। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার উপরে টর্চার শুরু করলে খুব দ্রুত আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখতে পাই আমাকে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের রুমে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সমস্ত শরীর পানিতে ভিজা ছিলো। ধারণা করতে পারি আমার জ্ঞান ফিরানোর জন্য আমার শরীরে পানি ঢালা হয়েছে। টিএফআই সেল এবং ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনা আমার লেখা “জেল থেকে জেলে” নামের বইতে বিস্তারিত লিখেছি। বইটি ২০১২ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছিলো। ২০১৩ সালে আমি দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার হলে আমাকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় আমি ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলাম। দ্বিতীয় দফার রিমান্ডের সময় আমার সাথে তৎকালীন ছাত্র শিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সাথে সাক্ষাত হয়। এর আগে আমি দেলোয়ার হোসেনকে চিনতাম না। দুই দিন আমার সাথে দেলোয়ার হোসেন ডিবির একই গারদে ছিলো। সেই সময় আমি দেলোয়ারের উপর ভয়াবহ টর্চার দেখতে পেয়েছি। তাকে সন্ধ্যার পরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সেল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। মধ্য রাতে ২/৩ জন পুলিশ তাকে বহন করে আবার গারদে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। টেনে নিয়ে আসার পর সে শুধু যন্ত্রনায় কারাতো, কথা বলতে পারতো না, উঠে দাঁড়ানোর কোন শক্তি থাকতো না। দুই দিন পর ডিবি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, আমার সাথে দেলোয়ারকে রাখলে ভবিষ্যতে আমি তার উপর নির্যাতনের সকল কাহিনী প্রকাশ করবো। সেজন্য তাকে আমার গারদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। আমি এবং দেলোয়ার শেখ হাসিনার ১৫ বছর ব্যাপী জুলুমের প্রত্যক্ষ উদাহরণ। ভিন্ন মত এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর জুলুমকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে ইসলামী জংগীবাদের অপপ্রচার করে। জংগী দমনের নামে তারা কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরী করেছে। এই সমস্ত নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় জনগনের উপর জুলুম চালানো হয়েছে। এদেরকে জংগী সাজিয়ে ফেইক এনকাউন্টারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভিকটিম বানানো হয়েছে যাতে করে তাদের জন্যে বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এরকম একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির জংগী নাটক। সেখানে ডিবি থেকে কয়েকজন গুমের ভিকটিমকে ধরে এনে জংগী সাজিয়ে হত্যা করা হয়। এই পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই জংগী নাটকের মূল ভূমিকা পালন করেছিলো পুলিশের মনিরুল ইসলাম এবং আসাদুজ্জামান সারাদেশে কিছু দিন পরপর এই ধরণের জংগী নাটক সাজানো হয়েছে যাতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা নিজেকে ইসলামী জংগীবাদ বিরোধী একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে শেখ হাসিনা জংগী দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পিছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ তার সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দীক মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি যুগিয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক এটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চীফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছে। নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনারবৃন্দ এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যবৃন্দ বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধবংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার এবং তাদের সংগীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরীতে ভূমিকা রেখেছে। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, শমশের মুবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিজবাউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দীকি, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পিছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী এবং ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে ৩ সেনা প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না। ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মোঃ আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাববেজ শামস এবং হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব‍্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেষ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিলো। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সব সময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে।

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানিন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ এবং ২০২৪ এর ভুয়া নির্বাচনের পরেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আমেরিকা এবং ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণেরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে। এই প্রসঙ্গে আমি বুয়েটের শহীদ আবরার ফাহাদের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই কেবলমাত্র ভারতের আধিপত্ববাদের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার জন্যে সারারাত ধরে তার উপর নির্মম অত্যাচার করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছিলো। আমি বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের চিত্র আমার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১৫ টি বই প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে ২ টি ইংরেজী ভাষায়। প্রাসঙ্গিক বইয়ের মধ্যে “হাসিনার ফ্যাসিবাদ নির্বাসন থেকে দেখা”, “গুমের জননী”, “The Political History of Muslim Bengal” এবং “The Rise of Indian Hegemon in South Asia”

আপনার মতামত লিখুনঃ