2.1 C
Munich
Monday, December 23, 2024

আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ দেখতে আসেনি, কারণ আমার পরিবারে কেউ নেই

জনপ্রিয় সংবাদ

কয়েক বছর আগে বাবার কবর খুঁজতে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। পেয়েছিলেনও। দাদা-দাদি কিংবা চাচা-ফুফুরা ইমরানকে কাছে পেয়ে আদর করে থাকতে দেন, খেতে দেন। তবে রাতের মধ্যেই কী যেন হয়ে গেল! পরদিন সকাল থেকেই শুরু হলো বঞ্চনা। এক সময় টিকতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে গাজীপুরের বউ বাজারে ফিরে আসেন ইমরান।

ইমরানের মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়; যার চেহারাও ঠিক মনে করতে পারেন না তিনি। মারা যাওয়ার আগে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে এক খালার কাছে রেখে গিয়েছিলেন ইমরানকে। সেই খালার কাছেই বেড়ে উঠেন। কিন্তু ছোট বেলার মত ভাগ্য যেন এখনও সহায় হচ্ছে না ইমরানে।

বড় হওয়ার পর যখন জানতে পারলেন, এটা তার আসল পরিবার না। খালার সংসারে অভাব-অনটন ও অবহেলা সইতে না পেরে সেখান থেকেও চলে যান এক পর্যায়ে। চেষ্টা করতে থাকেন চলার জন্য ছোট কোন কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার। ভর্তি হন টঙ্গী সরকারি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষে। কিন্তু ভর্তি থাকলেও অভাবের কারণে সেটা থমকে যায়।

আমার কিছুই নেই। পরিবার নেই, সম্পদ নেই, বাড়ি নেই, তবুও সুস্থ শরীর নিয়ে তিনবেলা খেয়ে বেঁচে ছিলাম। দেশের জন্য প্রচণ্ড আবেগ কাজ করায় আন্দোলনে যোগ দেই। একটা পরিবর্তন হলে ভালোভাবে বাঁচতে পারব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন সেই আশা ধীরে ধীরে শঙ্কায় রূপ নিচ্ছে —ইমরান হোসেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ভুক্তভোগী তরুন

আরও পড়ুনঃ  ইসরায়েলের ধ্বংস নিয়ে মহানবীর (সঃ) ভবিষ্যদ্বাণী

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হন এই যুবক। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে গুরুতর চিকিৎসা শেষে চোখের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ইতোমধ্যে হারিয়েছেন একটি চোখ। শরীরে রয়েছে অনেকগুলো ছররা বুলেট। তবে সেটার সংখ্যা কত— তা জানেন না ইমরান।

ইমরানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ দেখতে আসেনে, কারণ আমার পরিবার বলতে কিছু নেই’। সঙ্গে এ-ও বললেন, নিজের জমানো প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা ছিল, সেটাও খরচ করেছেন চিকিৎসার পেছনে। বাকি খরচ কীভাবে চলবে— সেটার বিষয়ে এই মুহুর্তে কিছু বলতে পারছেন না। হাসপাতালে পরিদর্শনে আসা বিভিন্নজন কিছু টাকা দিয়েছেন, সেটাই এখন একমাত্র ভরসা ইমরানের। এর বাইরে আর কোন পথ নেই। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকায় এখন কোন উপার্জনেরও সুযোগ নেই।

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের কয়েকজন ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইমরানের চোখের অবস্থা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোন পথ জানা নেই ইমরানের। স্পর্শকাতর জায়গা হওয়ায় কয়েকটি ছররা বুলেট এখনও বের করা যায়নি শরীর থেকে। যদিও শরীরজুড়ে সবমিলিয়ে কতগুলো বুলেট রয়েছে সেটির সংখ্যা এখনও ইমরান কিংবা চিকিৎসক কারোই জানা নেই। তিনি জানান, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন গন্তব্য আপাতত তিনি জানেন না।

আরও পড়ুনঃ  আজহারীকে স্বাগত জানিয়ে যা বললেন শায়খ আহমাদুল্লাহ

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা হলে ইমরান বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আগেই ভালো ছিলাম। এখন যত দিন যাচ্ছে ভেতরে কষ্ট বাড়ছে। শরীরে ক্ষতের যন্ত্রণা গভীর হচ্ছে। বলতে গেলে জীবনটা একটা শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। হঠাৎই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার কিছুই নেই। পরিবার নেই, সম্পদ নেই, বাড়ি নেই, তবুও সুস্থ শরীর নিয়ে তিনবেলা খেয়ে বেঁচে ছিলাম। দেশের জন্য প্রচণ্ড আবেগ কাজ করায় আন্দোলনে যোগ দেই। একটা পরিবর্তন হলে ভালোভাবে বাঁচতে পারব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন সেই আশা ধীরে ধীরে শঙ্কায় রূপ নিচ্ছে।’

ইমরান হোসেন আরও বলেন, যাকে আব্বু ডাকতাম তার বোন আমাকে দেখতে পারেন না। কারণ আমি কেন পরের খাবার খোয়াব? তখনই সেখান থেকে বের হয়ে নিজের ব্যবস্থা নিজে করার চেষ্টা করি।

‘এখানেও চিকিৎসা যেটা সম্ভব সেটা হয়েছে। এখন আর এখানে থেকে লাভ নেই। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। আমার ডান চোখটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখ শঙ্কায় রয়েছে —ইমরান হোসেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ভুক্তভোগী তরুন

কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে চোখের কোনায় পানি জমে ইমরানের। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের সাথে সবাই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য ছিল দেশের জন্য কিছু করা। কিন্তু এটা বলে কি আর লাভ হবে এখন? আগের পরিস্থিতি ফিরে পাওয়া যাবে না। এখন মনে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে জীবন-যাপন। অবহেলার পরিমাণ এখন বেড়ে গেছে। এর চেয়ে আগেই ভালো ছিলাম।’

আরও পড়ুনঃ  নওমুসলিমদের আইনজীবী ছিলেন আলিফ, এ জন্যই ইসকনের টার্গেট

আহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে ইমরান বলেন, ‘১৮ জুলাই, তখন সকাল সাড়ে ১১ টার মতো হবে। উত্তরা রাজলক্ষী ব্রিজের গোড়ায় হঠাৎ কোত্থেকে বুলেট এসে লাগে বুঝতে পারিনি। সাথে সাথে ঢলে পড়ে যাই, আমার আর সেন্স ছিল না। এরপর সাথের ভাইয়েরা প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল নিয়ে যায়। সেখান তারা রাখেনি, পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসে। ঢামেকে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ দিন চিকিৎসা শেষে ডাক্তাররা এখানে পাঠায়।’

ইমরান হোসনে যোগ করেন, ‘এখানেও চিকিৎসা যেটা সম্ভব সেটা হয়েছে। এখন আর এখানে থেকে লাভ নেই। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। আমার ডান চোখটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখ শঙ্কায় রয়েছে।’

স্বাস্থ্য উপকমিটি কোন খোঁজ নেয় কিনা জানতে চাইলে ইমরান জানান, ‘সবাই আসে, লিস্ট করে নেয়, এ পর্যন্তই। এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য কোন অর্থ কিংবা পরামর্শ পাইনি। সরকার কোন খোঁজ নেয়নি। ডাক্তাররাও এসে দেখে যায়, কিন্তু আমার অবস্থা কি সেটা নিয়ে তারা কোন কথা বলেন না। যদি তারা কিছুটা কথা বলত তাহলেও অন্তত মনে শান্তি পেতাম।’

সর্বশেষ সংবাদ