1.7 C
Munich
Monday, December 23, 2024

ইমিগ্রেশন এখনো আওয়ামী পুলিশের নিয়ন্ত্রণে

জনপ্রিয় সংবাদ

জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী সরর পতনের ৭৯ দিন পরেও পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট এসবি’র ইমিগ্রেশনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনার আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে। গত ১০ বছরের অধিক সময় ধরে এসবিতে কর্মরত সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি বিতর্কিত মনিরুল ইসলামের ঘনিষ্ট ২৫ বিসিএস কর্মকর্তা ফারজানা ইসলাম। তিনি সম্প্রতি ইমিগ্রেশনের এসএস হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। হযরত শাহজালাল (রা:) আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সকল ইমিগ্রেশনের পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের নানা অনৈতিক নির্দেশ মানতেও বাধ্য করেন ওই কর্মকর্তা। কৌশলে ইমিগ্রেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের ভারতসহ বিদেশ পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে ইমিগ্রেশনের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে বিদেশগামী ও বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাম ভাঙ্গিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সুপার (এসএস ইমিগ্রেশন) ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের নীতি নির্ধারক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ট হওয়ার পরেও ছাত্র-জনতার রক্তে গড়া বর্তমান সরকারের সময় ইমিগ্রেশনের মত স্পর্শকাতর এসবির ইউনিটের প্রধান হওয়ায় ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করার সাহস পান না মাঠ পর্যায়ের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। মাঠ পর্যায়ের এএসপি, ইন্সপেক্টর ও এসআইরা নিরবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ছেন এমন অভিযোগ অনেক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, এসএস ইমিগ্রেশন ফারজানা ইসলামের ভয়ে সব সময় থাকতে হয় আমাদের। তিনি বিভিন্ন সময় বিদেশগামী ও বিদেশ ফেরত সম্মানিক বাংলাদেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে বলেন ওই ব্যক্তির সম্পর্কে অন্য গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স লাগবে। তার পাসপোর্ট নাও এবং ওই ব্যক্তিকে ইমিগ্রেশনে বসিয়ে রাখ। এভাবে বহু যাত্রীকে সম্প্রতি সময়ে হয়রানি করা হচ্ছে, যা নিয়ে আমরা (মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা) বিব্রত। কখনো ৩০ মিনিট, কখনো এক ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় বসিয়ে রাখার পর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে সম্মানিত ওই সব বাংলাদেশী নাগরিকদের। অথচ এসব যাত্রীদের সম্পর্কে আগে থেকে কোন গোয়েন্দা তথ্য বা বর্তমান সরকারের নির্দেশনা না থাকলেও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এমনকি এসব যাত্রীর নানা কটু কথাও শুনতে হয় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।

আরও পড়ুনঃ  আইনজীবী আলিফ হ'ত্যা: তদন্ত কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন সব সদস্য

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সরকারী কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, গত সপ্তাহে তিনি দেশের বাইরে যান। কিন্তু হযরত শাহজালাল (রা:) আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাকে জানানো হয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স লাগবে। এক ঘন্টা পরে তাকে পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমি আওয়ামীলীগ সরকারের সময় বঞ্চিত কর্মকর্তা এবং সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছি এরপরেও আমাকে হয়রানি করা হয়। এটি পরিকল্পিত হয়রানি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এসএস ইমিগ্রেশন ফারজানা ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। সরকার পরিবর্তনের কারণে অনেক বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ করতে হয়। আমি পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছি। আপনি ১০ বছরের অধিক সময় ধরে এসবিতে কর্মরত এবং আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আপনার ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমরা আমাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করি। সরকার যখন যেখানে দায়িত্ব দিয়েছে তা পালন করেছি।

সরকারের একধিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর পুলিশ নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে ফিরতে অনেক দিন সময় লেগেছে। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ বাহিনীতে হাসিনার দোসররা এখনও বহাল আছে। ইতোমধ্যে হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, খুনি পুলিশ কর্মকর্তারা ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কিছুই জানেন না! তার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই! সাধারণ মানুষের প্রশ্ন তাহলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কী করছেন? তার কাজ কী?

আরও পড়ুনঃ  কেন বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে কমিশন গঠন হচ্ছে না

জানা গেছে, হাসিনার আমলের সুবিধাভোগি আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা এখনও ইমিগ্রেশনে কর্মরত আছে। স্বপদে বহাল থাকায় তারাই কৌশলে ইমিগ্রেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের ভারতসহ বিদেশ পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। এসবি সূত্র জানায়, সারাদেশে আকাশপথসহ স্থলপথে যতগুলো ইমিগ্রেশন আছে সবগুলোর সেন্ট্রাল সার্ভার একটাই। অর্থাৎ যে কেউ ইমিগ্রেশন অতিক্রম করতে গেলেই তার নামে কোনো অভিযোগ থাকলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকে দিতে পারে। হাসিনার পতনের পর বলা হয়েছিল, জীবনের নিরাপত্তার জন্য ৬২৬ জন নেতাকর্মী ঢাকা ক্যান্টনেমেন্টে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ৬২৬ জন পালিয়ে গেল কিভাবে? যারা ইতোমধ্যে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন তারা কিভাবে গেলেন? এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কঠোর কোনো নির্দেশনা থাকলে নিশ্চয় তা কার্যকর হতো। তা যখন হয়নি তার মানে হয় নির্দেশনা ছিল না, নয়তো আওয়ামীপন্থী পুলিশ কর্মকর্তারা সে নির্দেশনা না মেনে সহচরদের বিদেশ পাড়ি জমাতে উল্টো সহযোগিতা করেছে। যারা এ কাজ করেছে তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

অভিযোগ রয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে এখনও হাসিনার দোসররা বহাল তবিয়তে আছেন! স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কেন তাদেরকে বদলি করেন নি? একজন ভুক্তভোগি জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনে হাসিনার দোসররা এখনও বহাল থাকায় সাধারণ মানুষকে আটকে হয়রানি করা অব্যাহত রয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের কতো নেতা-পাতিনেতা ওই একই ইমিগ্রেশন পাড়ি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি কাহার আখন্দ হাসিনার ঘনিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কাহার আখন্দের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এবং পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত করে মনগড়া চার্জশীট দেয়ার অভিযোগসহ নানা অভিযোগ রয়েছেন। আর এর বিনিময়ে কাহার আখন্দ পেয়েছিলেন শত শত কোটি টাকা ও একের পর এক পদোন্নতি।

আরও পড়ুনঃ  প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই উপদেষ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক

পুলিশের বেশ কয়েকজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী পুলিশ কর্মকর্তাদের পদ পদবী এবং পদোন্নতি নিয়ে পুলিশ বিভাগে অস্থিরতা কমছেই না। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অনিয়ম-অপরাধের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছেন তাদের পদায়ন এবং পদোন্নতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিগত সময়ে বঞ্চিত এবং নিগৃহীত কর্মকর্তারা। পদোন্নতির কাতারে এমন কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আছেন যাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশের মতো ভয়াবহ অভিযোগ আছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এখনো আড়ালেই আছেন এমন কর্মকর্তাও পেতে যাচ্ছেন প্রমোশন।

একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় রয়েছে মানব পাচারে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সাথে আওয়ামীপন্থ’ী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ দীর্ঘদিনের। বিদেশগামী যাত্রীদের হয়রানির পাশাপাশি বিমানবন্দরের বিভিন্ন বিভাগের ধান্ধাবাজির অভিযোগও রয়েছে বিগত সরকারের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তারা (সাবেক আ’লীগ ক্যাডার কর্মকর্তা) আবার সক্রিয় হলে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের শত শত শহীদের আত্মা যেমন শান্তি পাবে না, তেমনি দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হবে।

সর্বশেষ সংবাদ