ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে বিভিন্ন ইস্যুতে যখন টানাপোড়েন চলছে, ঠিক এই পরিস্থিতিতে আজ সোমবার ঢাকা আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। এটিই হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতীয় কোনো সিনিয়র কর্মকর্তার প্রথম ঢাকা সফর। আর ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এই সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই এমনটি ধারণা করছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) যোগ দেবেন বিক্রম মিশ্রি। আনুষ্ঠানিক আলোচনার আগে দুই সচিব কিছুটা সময় একান্তে কথা বলবেন। দিল্লির আগ্রহেই সচিবদ্বয়ের ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা। একদিনের ওই সফরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার পৃথক সৌজন্য সাক্ষাতের সূচি রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি এবং কূটনীতির রসায়ন স্বতন্ত্র। আলোচনার আগে বা পরে নতুন সিদ্ধান্ত কিংবা ঘোষণা আসা অমূলক নয়। তবে এটা ঘোষণা হোক বা না হোক টানাপোড়েন সত্ত্বেও দিল্লির বিদেশ সচিব যখন আসছেন, তখন গণআন্দোলনের মুখে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ তথা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কোন না কোন ফর্মে আলোচনা হবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত। একই সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে আসতে পারে পাকিস্তান ও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কও। ইতোমধ্যে আদানিসহ নানা ইস্যুতে আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প জয়লাভ করার পর ভারত যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, গত কয়েকদিন ট্রাম্পের ভারতবিরোধী বক্তব্যে সেই উচ্ছ্বাস অনেকটাই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ভারত মূলত চতুর্মুখী চাপে আছে।
এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় অবস্থানকালে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশের রাষ্ট্রদূত (২০ জন অনাবাসী রাষ্ট্রদূতসহ) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ মোট ২৮ জন সমবেতভাবে বৈঠক করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত একত্রিত হয়ে সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ এবারই প্রথম। এ বৈঠক বাংলাদেশ ও ইইউয়ের সম্পর্ক আরও সুসংহত করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এই বৈঠকও ভারত সরকারকে প্রচ্ছন্ন একটা বার্তা দিবে।
গত বছর ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে এফওসি বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। তবে এক বছরের ব্যবধানে দুই দেশেরই পররাষ্ট্র সচিব পরিবর্তন হয়েছে। আজ ঢাকায় এফওসিতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন। আর ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ঢাকা-দিল্লির এফওসিতে বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচনায় উঠতে পারে। বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যম এখন বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঢাকার পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপন করা হতে পারে। এছাড়া ভারতে বাংলাদেশ মিশনে নিরাপত্তা, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নিত্যপণ্য আমদানি, ভিসা ইস্যু ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। ঢাকা-দিল্লির পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে কি কি বিষয়ে আলোচনা হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, এফওসিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে যত উপাদান আছে সবগুলোই রাখার চেষ্টা করা হয়। আলোচ্যসূচি ঠিক করার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সম্মতিও লাগে। তবে সাধারণভাবে যেটা বলা যায়, বাণিজ্য আছে, কানেক্টিভিটি আছে, সীমান্ত আছে, পানি আছে। এ বিষয়গুলো আলোচনাতে থাকবে।
সম্পর্কের বরফ কী গলবে?
স্বৈরাচারি হাসিনার পতন তথা অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম ভারতের কোনো শীর্ষ কূটনীতিক ঢাকায় আসছেন। যদিও ৫ আগস্টের পর গত চার মাসে দুদেশের তিনটি টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হয়েছে। তবে এমন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এখনো হয়নি। এই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন অনেকটা প্রশমিত হতে পারে বলে ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গতকাল রোববার তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ৫ আগস্টের আগে এবং পরে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এটা মেনে নিয়ে আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সে হিসেবে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, আমাদের যে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কনসালটেশন আছে সেটি শুরু করবো।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কারণে দুই দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের রিজার্ভেশনের কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতা ছিল না। প্রতি বছর সামিট হওয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সার্কের মাধ্যমে সেটা করা যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সার্কের কার্যক্রম শুরু করা দরকার। প্রধান উপদেষ্ট ড. ইউনূসও চান সার্কের কার্যক্রম শুরু হোক। তিনি বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি, আমরা (ঢাকা-দিল্লি) স্বাভাবিক সম্পর্কের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এফওসি হবে সেদিকে এগোনোর প্রথম পদক্ষেপ। এফওসির মধ্যে দিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে বাস্তবসম্মতভাবেই এগিয়ে যেতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এফওসির আলোচনার এজেন্ডায় যাই থাকুক, সব ধরনের উসকানি নিরসন করে উত্তেজনা কমিয়ে এনে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এবারের এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এদিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এফওসি সম্পর্কে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা করবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির বাংলাদেশ সফর নিয়ে চলতি মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতে আলোচনা বেশ তুঙ্গে। এর আগে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বহু কর্মকর্তা পারস্পরিক সফর করেছেন। কিন্তু কোনো সফর নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনা-পর্যালোচনা দেখা যায়নি। এবার বিক্রম মিশ্রির সফর নিয়ে এত জল্পনা-কল্পনার অন্যতম কারণ-দুই দেশের সম্পর্কের অব্যাহত অবনতি। বলার অপেক্ষা রাখে না, গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের পারদ কখনোই এতটা তুঙ্গে ওঠেনি। তাই বিক্রম মিশ্রির সফর নিয়ে এত আলোচনা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটা ঘটনাকে ভারতীয় মিডিয়া হিন্দুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। গত কয়েক মাসে একই ইস্যুতে মিথ্যা খবর প্রচারের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। এমনকি এসব মিথ্যা খবর নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলের নেতাদেরকেও সরব হতে দেখা যায়। যেগুলো ফ্যাক্টচেকে ইতোমধ্যে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে ভারতের অব্যাহত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ড. ইউনূস বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে এসে পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মোদি সেই আহ্বানে সাড়া দেননি। তবে গত চার মাসে দু-দেশের মধ্যে তিনটি টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কের উন্নতি হয়নি।
এর মধ্যে গত ২৬ নভেম্বর সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলে পুলিশ। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, তারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
এরপর বাংলাদেশে ভারতের পতাকা অবমাননার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ নিয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা করবেন না বলে ঘোষণা দেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২ ডিসেম্বর বিধানসভার অধিবেশনে বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো উচিত। এ জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
এ ছাড়া আগরতলায় বাংলাদেশে মিশনে গত ২ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুত্বাদীরা হামলা চালায়। এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানায় ঢাকা। এসব ঘটনায় দুই দেশের মানুষের মধ্যেই তীব্র ভারতবিদ্বেষ ও বাংলাদেশ বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। অবনতি হয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও। আর তাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে এত আলোচনা।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠক করতে অনুরোধ করেছিল ঢাকা। কিন্তু দিল্লি ওই অনুরোধে সাড়া দেয়নি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, চতুর্মুখী চাপের কারণেই ভারত মূলত কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ইউনূস সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, চীন ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের গতিতে অনেকটাই একা হয়ে পড়ছে ভারত। সেই চাপ থেকে মুক্ত হতেই ভারত এফওসির মাধ্যমে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ শুরু করতে চাচ্ছে। ভারতের সংবাদমাদ্যম দ্য স্টেটসম্যান এমনই আভাস দিয়ে জানিয়েছে, এবারের এই বৈঠকে ভারতের অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প পুনরায় শুরু করা, ভিসা ব্যবস্থার সহজীকরণ, সরাসরি ফ্লাইট বাড়ানো এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়গুলো আলোচনা করা হবে।
বিক্রম মিশ্রির সফর নিয়ে কী বলছে ভারত
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, বিক্রম মিশ্রির এই সফরটি এমন এক সময়ে হতে চলেছে, যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে অভূতপূর্ব উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। হিন্দু সংখ্যালঘু ইস্যু এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের পর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যে বিক্ষোভ হচ্ছে। ফলে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের এই সফরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকটির ব্যাপারে বিস্তারিত না জানালেও গত শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জসওয়াল বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের মূল বৈঠকটি হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে মিশ্রির।
বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বড় সীমান্ত রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের। ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দুদিন আগে স্থানীয় এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চাই না। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে যদি কেউ আগুন লাগায়, তবে বিহার-উড়িষ্যাও রক্ষা পাবে না। আমি চাই, আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদের সঙ্গে শান্তিতে বাস করুক।
বাংলাদেশ-ভারতের উত্তেজনা কি কমাতে পারবে এই সফর?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনায় বিক্রম মিশ্রির সফর কতটা পানি ঢালতে পারবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে তাঁর এই সফর যে দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা অনুমান করাই যায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, বৈঠকে কোন বিষয়টিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব, তা এখনই স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে সাধারণভাবে সব ইস্যু নিয়েই আলোচনা হবে। ভারতের সঙ্গে তো আমাদের অনেক মেকানিজম আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের ট্রেড আছে, কানেকটিভিটি আছে, পানি আছে, বর্ডার আছে এগুলো অবশ্যই থাকবে। সুনির্দিষ্টভাবে এজেন্ডায় কী থাকবে সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। সাম্প্রতিক ইস্যুও এর মধ্যে থাকবে। সংশ্লিষ্ট উইং এখনো এগুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। উনি আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো পর্যালোচনা, রাজনৈতিক বোঝাপড়া, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার, ভারতে বসে হাসিনার বক্তব্য, ভিসার জট খোলা, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রফতানির নানা বাধা সরানোসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এই বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যে আসছেন এতেই দুই দেশের মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও এটা রুটিন। তারপরও ভারত সরকার বাণিজ্য চালিয়ে যেতে যে পলিসি নিয়েছে, সেটাকেও আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। ইস্যু অনেক আছে। ভারতীয় হাইকমিশনার দুই দিন আগে বলেছেন, একটা ইস্যুতেই যেন সম্পর্ক না আটকে থাকে। আমি আশা করবো, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যা যা আমাদের মধ্যে ছিল, সেটার চেষ্টা করবেন দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য কিন্তু অনেক। মেডিকেল আর ট্যুরিজম বাদে যদি আমরা দেখি, যেমন আমরা লাভবান, তেমনি তারাও লাভবান। ভারতের যেমন আমাদের দরকার, তেমনি আমাদেরও ভারতকে দরকার। আমি আশা করি, বাংলাদেশ যেন ইতিবাচক বার্তা দেয়, যদিও আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই একবার বলেছেন। তেমনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকেও ইতিবাচক বার্তা আসবে- সেটা আমি আশা করি। এখন অনেক ইস্যু থাকলেও বরফ গলাতে লিস্ট লম্বা করতে চাই না। যোগাযোগটা আগে ঠিক হোক। ভিসাটা চালু হোক। ব্যবসায় যেন বাধা না থাকে।
ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর অব্যাহত অপপ্রচার নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, এই মুহুর্তে বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এর মধ্যে ভারতের মিডিয়া যে নিউজ দিচ্ছে সেটা কিভাবে থামানো যায়। প্রয়োজন হলে ভারতের মিডিয়া টিম বাংলাদেশে আসতে পারে। সেটা পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে না হলেও আলাদাভাবে আসতে পারে-সেই সুযোগটা তৈরি করা। তাহলে যে নেতিবাচক খবর হচ্ছে, সেটা হয়তো থামবে।
প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেন, দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে যদি কথাবার্তা শুরু হয়, তাহলে দুই দেশই বুঝতে পারবে কোথায় কাজ করা প্রয়োজন। এটা ভারতের জন্যই দরকার। কারণ, তাদের বুঝতে হবে, জনগণের যে আকাঙ্খা, যেটা গত কয়েক বছর ধরে প্রতিফলন হয়নি। আবার তাদের দিক থেকে যে সমালোচনাটা আছে সংখ্যালঘু নিয়ে, সেটাও অ্যাড্রেস করা যেতে পারে। আসলে আলোচনা হলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
এর আগে গত মঙ্গলবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা বলেন, কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না। আমরা আমাদের আলোচনা চলমান রাখবো। আমাদের পরস্পর-নির্ভরতার বিষয় রয়েছে, যেটি দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ দুই মাসে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অনেক ইতিবাচক বিষয় রয়েছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। একসঙ্গে কাজ করে যাব।