চট্টগ্রামে দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা হয়েছে বেশ কয়েকবার। হিন্দু অথবা বৌদ্ধদের মন্দির এবং উপাসনালয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দাঙ্গা লাগানোর এ অপচেষ্টা করা হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে পতিত স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রী স্বঘোষিত ইসকন সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তার নির্দেশে চট্টগ্রামের কিছু ছাত্রলীগ নেতা দাঙ্গা বাজানোর ওই চক্রান্ত করে।
তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত যৌথ বাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপে ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাষ্ট্রদ্রোহী ওই চক্রান্ত আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। চট্টগ্রামে হিন্দুদের মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বৌদ্ধমন্দির ভেঙে তার দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এক গভীর নীলনকশার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত এখন গোয়েন্দাদের হাতে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ নীলনকশা বাস্তবায়নে অজ্ঞাত স্থান থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন নওফেল। ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা এ অপকর্ম বাস্তবায়নে নিজেদের মধ্যে আলোচনা এবং দফায় দফায় বৈঠক করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। চট্টগ্রাম থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে তার দায় ছাত্রজনতার উপর চাপিয়ে দিয়ে একদিকে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী পতিত স্বৈরাচারি হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের নীলনকশা প্রণয়ন করে তারা। এ সংক্রান্ত ছাত্রলীগ নেতা ও নওফেলের সহযোগীদের মধ্যে ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথনের কিছু তথ্য ইনকিলাবের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা মো. আসিফুর রহমান মিনহাজ নওফেলের এক সহযোগীর সাথে দাঙ্গা সৃষ্টির পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করছেন।
মিনহাজ লিখেন, ‘হিন্দুদের কিছু দোকান আছে ওইগুলো ভাঙারি বানিয়ে ফেলব। ইনশাআল্লাহ দাঙ্গা লেগে গেলে হিন্দু বৌদ্ধরা আর ছাত্রদের পক্ষে থাকবে না। উনারাই মিলে আবার আমাদের সরকারকে পা ধরে মাফ চেয়ে দেশে আনবে। আবার নওফেল ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মহসিন কলেজ জেগে উঠবে।’
জবাবে নওফেলের সহযোগী লিখেন, মহসিন কলেজের বীর তুমি। ইনশাআল্লাহ তোমাকে তোমার ক্লাসের সভাপতি দিয়ে দেব। সব সেকশন তোমার হাতে থাকবে। পারলে মূর্তির মাথাগুলো ভেঙে দিবা হিন্দু বৌদ্ধ যে কোন মন্দির পাও। মাথায় রাখবা এ দেশ বাঁচানোর দায়িত্ব তোমাদের হাতে।
জবাবে মিনহাজ লিখেন, পাশে থাকবেন ভাই। মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার জন্য ছাত্রলীগ কর্মীদের গণি বেকারী, জামালখান ও চেরাগি পাহাড় এলাকায় জড়ো হতে বলা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ ধরে প্রয়োজনে কারও মাথায় টুপি রাখতেও বলা হয়। এ অবস্থায় মন্দিরে হামলা করলে পুরো দোষ পড়বে ছাত্রদের উপর। আর তাতে দাঙ্গা শুরু হবে এবং সাধারণ মানুষ ছাত্রদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। মিনহাজ লিখেন, ভাই আমাদের পাশে থাকবেন। কিছু হিন্দুদের দোকান আছে ওইগুলো ভাঙারি বানিয়ে ফেলব।
জবাবে নওফেলের সহযোগী বলেন, ‘সাব্বাস!
আচ্ছা তোমাদের কাজ ফিনিশ করে আমাকে জানিও। আর স্টুডেন্ট সরে গেলে দ্যান তোমরা হামলা দিবা। মামুনকে টুপি দিছি। সবাই সাদা টুপি মাস্টবি পড়বা। যাও ভাইয়া, আমাকে আপাতত কল দিওনা। ফোন অফ করতেছি। প্রবলেম হবে আমার। তোমাদের রিক্স লাগলে টুপি ফেলে দিয়ে দৌঁড়াইও। রাতে মিটিংয়ে দেখা হবে ভাইয়া।’
দাঙ্গা বাজানোর এসব অপকর্ম করলে ভবিষ্যতে পুরস্কার দেওয়ারও আশ^াস দেন নওফেলের ওই সহযোগী। তিনি লিখেন, ‘তাড়াতাড়ি কাজে নামো ভাইয়া। আমাদের সরকারের এখন তোমাদের হাতের উপর ভরসা। ইনশাআল্লাহ সরকার আসলে তোমার ফুল ক্যারিয়ারের দায়িত্ব আমি নওফেল ভাইকে বলে ছেট করে দিব। জাস্ট সংগ্রাম করে যাও ভাইয়া।’
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব তথ্য হাতে পাওয়ার পর ষড়যন্ত্রকারী নওফেলের সহযোগীদের ধরতে মাঠে নেমেছে।
উল্লেখ্য, ছাত্রজনতার বিপ্লবের মুখে বিগত ৫ আগস্ট মাফিয়া সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের বাসাবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চক্রান্ত শুরু হয়। এর মধ্যদিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং দেশে দাঙ্গা তথা নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করে পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা। তবে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর তাৎক্ষণিক কর্মসূচি বিশেষ করে হিন্দুদের মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দলীয় কর্মীদের দিয়ে পাহারা বসানোর ফলে এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এরপর দুর্গাপূজা এবং বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়েও নাশকতার অপচেষ্টা হয়। সেটিও ব্যর্থ হয় পুলিশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নানা তৎপরতার কারণে। এরপর ইসকনসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে একের পর এক বিভিন্ন কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে নগরীর হাজারী গলিতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা হয। সেখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের উপর এসিড হামলার ঘটনাও ঘটে। তবে যৌথবাহিনীর শক্ত অবস্থান এবং সাঁড়াশি অভিযানের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ওই অপচেষ্টাও ভেস্তে যায়। একের পর এক নাশকতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি এসব চক্রান্তের পেছনে ভূমিকা রাখছে পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যে তথ্য তাতে স্পষ্ট অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে থাকা নওফেলসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কতিপয় নেতা এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। তবে নওফেল পালিয়ে থাকায় এসব বিষয়ে তার কোন বক্তব্য জানতে পারেনি দৈনিক ইনকিলাব।