সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিক অঙ্গন থেকে চায়ের দোকান, টিভি টকশো, সর্বত্রই চলছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা। দীর্ঘ সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সারা দেশে বেড়েছে শিবিরের মুক্ত বিচরণ।
সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কাইয়ুম ও সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ। এতে বেশ নড়েচড়ে বসেছে অন্যান্য রাজনীতিক দলের ছাত্রসংগঠন। অনেকটা নাটকীয়ভাবে তাদের আত্মপ্রকাশ। আত্মগোপনে থেকে ভেতরে ভেতরে সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাড়াতে সক্ষম শিবিরকে অনেকে তুলনা করছেন বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে।
নেটিজেনরা বলছেন, তারা ক্যাম্পাসেই ছিলেন। কিন্তু তার সহপাঠী, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব এমনকী রুমমেট যার সঙ্গে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, সেই ছেলেটিও বিন্দুমাত্র টের পাননি। আর এতেই অবাক হচ্ছেন তারা।
সাধারণত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঘাঁটি। বিশেষ করে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তাদের ক্যাম্পাসভিত্তিক কার্যক্রম বেশ জোরে শোরেই চলছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক দমনপীড়নে স্থবির হয়ে পড়ে শিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম। তালা মারা হয় কেন্দ্রীয় দপ্তরসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সব কার্যালয়।
ঢালাওভাবে হামলা-মামলা ও নির্যাতনের মুখে সাংগঠনিক পরিচয় গোপন রেখে ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসের আশেপাশে থাকতে শুরু করেন শিবিরের নেতাকর্মীরা। অন্য ছাত্র সংগঠনের কাছে ধরা না দিয়ে কীভাবে শিবির নেতাকর্মীরা সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটান, তা যেন এক মহাবিস্ময়। বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনে প্রতিবছর যথারীতি হয়েছে তাদের নেতৃত্ব বদল, পর্যালোচনা আর নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই মাস যেতে না যেতেই ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় ছাত্রশিবির। নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের আঁতুড়ঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রকাশ্যে এল তারা।
অনেকেই মনে করতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে শিবিরের আঁতুড়ঘর হয়? সংগঠনটির ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম আলী।
জানা গেছে, গত ১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এর চারদিন পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ২৮ আগস্ট জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠা লাভ করে সেই ক্যাম্পাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে জামায়াতে ইসলামীর ভাতৃপ্রতীম এ সংগঠন। তবে শিবিরে ছাত্রীদের প্রবেশাধিকারের কেনো সুযোগ নেই।
ছাত্রশিবিরের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতি হিসেবে মঞ্জুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে জাহিদুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই সংগঠনে ৩৩ জন সভাপতি এবং ২৬ জন সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন।
সংগঠন পরিচালনার অর্থ কর্মী, সাথী, সদস্য প্রার্থী, সদস্য ও শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হয়। শিবিরের এই তহবিলকে বলা হয় বায়তুলমাল। সাংগঠনিক প্রকাশনীর মুনাফা ও শরিয়াত অনুমোদিত অন্যান্য খাত এই তহবিলের অন্যতম উৎস। দীর্ঘ ১৭ বছর পর গত ২১ সেপ্টেম্বর ফেসবুক বার্তায় নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
সম্প্রতি ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকেই ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরু হয়। সেই ঢাবিতে শিবিরের কার্যক্রম থাকবে না এটা কীভাবে সম্ভব!
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সভাপতি ও সেক্রেটারির আত্মপ্রকাশকে তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তবে একজন একজন করে নয়, ক্যাম্পাসে সবার পরিচয় প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।