রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ইসলামী দলগুলোর কর্মতৎপরতা বেড়েছে। যার যার অবস্থান থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করছে বিভিন্ন ইসলামী দল। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যস্ত দলগুলোর নেতাকর্মীরা। নতুন প্রেক্ষাপটে একটি ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়তে বিভিন্ন ইসলামী দল পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে ইসলামী কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ লক্ষ্যে দলটি এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছে। যার মধ্যে পাঁচটি ইসলামী দল এবং আলেম সমাজ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ—এমনটা বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইছেন। এ লক্ষ্যে দলটি যোগাযোগ বাড়িয়েছে। তবে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার বিষয়টি এখনো দৃশ্যমান নয়। চূড়ান্ত রূপ নিতে আরও সময় লাগবে বলে সূত্র জানায়। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলের নেতারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কিছু মতানৈক্য রয়েছে। যে কারণে ঐক্য গড়তে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য গড়তে কোনো বাধা হবে না। জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ঐক্য শক্তিশালী হবে না বলে অধিকাংশের মত।
গত ২১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সমমনা দলগুলোর একটি বৈঠকও হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। গত শনিবার লাখো জনতার অংশগ্রহণে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল। সেখানে বিভিন্ন আকিদার বক্তারা দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ইসলাম ও দেশের স্বার্থে সব বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে দলটি সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। দলটির শীর্ষ নেতারা সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠকে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন। তারই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ২৩ দিনের মাথায় দল নিষিদ্ধের আদেশও প্রত্যাহার হয়। এখন বিভিন্ন ইসলামী দলের সমন্বয়ে একটি ‘নতুন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, আমরা বিভক্তিতে বিশ্বাসী নই। দেশের সব জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুন্দর জাতি গঠন করতে চাই। এজন্য প্রতীক্ষায় আছি।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলীম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। অবশ্য ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। আর খেলাফত আন্দোলন জোটের অবস্থানের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। সমমনা ইসলামী দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয়। তারা জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে।
একাধিক ইসলামী দলের কয়েকজন নেতা কালবেলাকে বলেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের এখনো কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। যে কোনো সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। সুতরাং জামায়াতসহ ইসলামপন্থিদের যে নির্বাচনী ঐক্যের তৎপরতা চলছে, তা শেষ পর্যন্ত কত দূর যায়, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুফতি ফয়জুল করীম ও খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, ঐক্য গড়তে তাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে তার আগে জামায়াতকে ধর্মীয় কিছু বিষয়ে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর লেখা নিয়ে আলেমদের সঙ্গে যে বিরোধ, তা নিরসন করতে হবে।
ইসলামী দলগুলোয় বেড়েছে যোগাযোগ:
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও নতুন প্রেক্ষাপটে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন জামায়াতে ইসলামী। দলটি ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ১২-দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন।
এসব মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতারা জানান, জামায়াতে ইসলামী দেশে ইসলামপন্থিদের মধ্যে একটি ঐক্য চায়। বিশেষ করে নির্বাচনী ঐক্য। এ লক্ষ্যে জামায়াত এরই মধ্যে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনী ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা দেখছে না। অবশ্য জামায়াত নেতাদের মতে, ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য হবে কি না, সেটি নির্ভর করছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। জামায়াতের পর ইসলামপন্থিদের সমর্থনের দিক থেকে এই দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
রাজনীতিকদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু বক্তব্য ও তৎপরতায় বিএনপির হাইকমান্ড অস্বস্তি প্রকাশ করে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বাহ্যিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কেননা বিএনপি সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। পক্ষান্তরে জামায়াত দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের চেয়ে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতেও চায় জামায়াত। দল দুটির এই ভিন্ন অবস্থান আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে বিএনপি। এরপর ২০-দলীয় জোটের দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করলেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রকাশ্যে আসেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে ‘একদফা’ দাবিতে গত ২৬ জুলাই বিএনপি মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতি ‘জাতীয় ঐক্যের’ যে আহ্বান জানালে উভয় দলের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এমনকি জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বিএনপির আহ্বানে সাড়া দেয়।
জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতের নেতৃত্ব সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে চাইছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা জানান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এক বছর সময় দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে দলের নির্বাহী পরিষদে। সেভাবেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঐক্যের প্রশ্নে কী বলছেন নেতারা:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম কালবেলাকে বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এখন ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের প্রত্যাশা আছে। সেজন্য বিভিন্ন ইসলামী দল একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গড়তে চায়। এ বিষয়ে সমমনা অন্যান্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের উদ্যোগ হয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি নির্বাচনী আবহ এখনো তৈরি হয়নি। সব রাজনৈতিক দল যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যেও ২১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীতে জামায়াতের বাইরে সমমনা ইসলামী দল ও আলেমরা বৈঠক করেছেন। সেখানে আলোচনা হয়েছে আগে নিজেদের ঐক্য গড়তে হবে। এরপর কার সঙ্গে ঐক্য হওয়া যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যাদের ব্যাপারে শরয়ি কোনো আপত্তি নেই, তাদের নিয়েই ঐক্য হবে। আমরা বলেছি, আমাদের ভুলত্রুটি থাকলে বলবেন শুধরে নেওয়া হবে।
খেলাফত মজলিসের (দেওয়াল ঘড়ি) মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের কালবেলাকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার এখনো তেমন কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। যেহেতু নির্বাচনের সুস্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে বা আবহ তৈরি হলে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সম্প্রতি বলেছেন, ঐক্যের বা আলোচনার মূল সূত্র হচ্ছে মতভিন্নতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামের যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। আবার যেগুলো চাই না, সেই অপতৎপরতাকে মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আলোচনা যেভাবে হয়, সেটাই হবে।