সমুদ্র সকালে বের হওয়ার সময় বলেছে, জুমার নামাজ পড়ে বাসায় এসে দুপুরের ভাত খাবে। আমি ভাত বেড়ে তার অপেক্ষায় থাকি। দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে তাকে ফোন করে খেতে আসতে বলি। সে “দুই মিনিট পর আসতেছি” বলে। দুপুর গড়িয়ে যায়। সমুদ্র বাসায় আসে না। টেবিলে ভাত বেড়ে আমি নামাজ পড়তে যাই। এমন সময় একটা ফোন আসে। ওপাশ থেকে বলে, আমার সমুদ্র গুলি খেয়েছে।’
‘আমার বাবা আর ভাত খেতে আসে না। আমি অপেক্ষায় থাকি। আমার অপেক্ষা শেষ হয় না। আমার ছেলে দেশের জন্য রক্ত দিল। অথচ এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই কথাগুলো বলেন জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় নিহত মো. মোস্তফা জামান সমুদ্রের মা মাসুদা জামান (৫৯)। খবর বাসস।
সন্তানহারা বাবা মো. মনিরুজ্জামান তাজুল আকুতি করে বলেন, ‘আদরের সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ছেলেকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু ছেলের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি যেন দেওয়া হয়। সরকার যেন সব শহীদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়। সমুদ্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক ছিল। সমুদ্র দেশের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছে।’
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. মনিরুজ্জামান তাজুল রাজধানীর রামপুরায় মহানগর প্রজেক্টে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তার ছেলে শহিদ মো. মোস্তফা জামান সমুদ্র (১৭) ঢাকার আল-ফোরকান উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। সিদ্বেশ্বরী কলেজে ভর্তির প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কিন্তু যখন বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে তরুণরা রাস্তায় নেমে পড়ে, তখন সমুদ্রকেও ডাক দেয় সেই আন্দোলন।
বাবা মো. মনিরুজ্জামান তাজুল (৬৮) বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরুতেই মোস্তফা জামান সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। গত ১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মতো সমুদ্র সকালে বাসা থেকে সহপাঠীদের সঙ্গে রামপুরায় ডিআইটি রোডে নেমে আসে। বেলা ৩টায় আমি জুমার নামাজ শেষে বাসায় এসে ভাত খেতে বসি। আর সমুদ্রের মা নামাজে দাঁড়ায়। এমন সময় ওর এক বন্ধু ফোন করে বলে, সমুদ্র গুলিবিদ্ধ হয়ে ডেলটা হাসপাতালে আছে।’
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘খাবার ফেলে দৌড়ে ডেলটা হাসপাতাল গিয়ে দেখি পাঁজরে গুলিবিদ্ধ আমার ছেলে খালি গায়ে মেঝেতে পড়ে আছে। শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর গরম। সঙ্গে সঙ্গে কোনো রকমে সেখান থেকে পাশের বেটার লাইফ হাসপাতাল নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন রাতেই নিজ গ্রামে এনে জানাজা শেষে দাফন করি সমুদ্রকে।’
সমুদ্র এর আগের দিনও আন্দোলনে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তখন বাসার সবাই তাকে আর যেতে নিষেধ করেছেন বলে জানান মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন নিষেধ করেছিলাম বাইরে যেতে। তারপরও সকালে বন্ধুদের সঙ্গে রাজপথে নেমে আসে। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তির জন্য ফরম এনেছিল। পরের রোববার ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। সমুদ্রের ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে দেশেই ব্যবসা করবে।’
মনিরুজ্জামানের দুই ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে সমুদ্র ছিলেন সবার ছোট। তার বড় ছেলে মোর্শেদুজ্জামান পিএইচডি শেষ করে বর্তমানে জাপানে আছেন। আর মেয়ে মিরানা জামান স্বামীর সঙ্গে ফিনল্যান্ডে বসবাস করেন। তার ইচ্ছা ছিল ছোট ছেলেকে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন। কিন্তু সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। তাই ঢাকায় সব ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছেন মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর কেউ খোঁজ নেয়নি। আমরা কোনো আর্থিক সাহায্য চাই না।
সরকারের কাছে একটি দাবি জানিয়ে শোকাহত এই বাবা বলেন, আদরের সন্তান অবিচার, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। তাই সরকারের কাছে দাবি, আমার ছেলেসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়।