আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে তার পরেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পাঁচই আগস্টের পর থেকেই অনেকটা ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ তত্ত্ব দেয়া এই নেতা।
কথিত আছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পরে মূলত পাঁচ নেতা দল পরিচালনা করেছেন। শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাখতের এই নেতারা। আর এই পঞ্চপাণ্ডবই ছিলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার মূল ক্রীড়ানক। এই পাঁচ নেতা হলেন- ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য-গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ।
এই পঞ্চপাণ্ডবের সবচেয়ে বড় পাণ্ডব ওবায়দুর কাদের এখন কোথায়? তিনি দেশে, নাকি বিদেশে? এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্যসহ নেট দুনিয়াতেও রয়েছে নানা চর্চা। তার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও, এরিমধ্যেই আওয়ামী লীগে নিজের সাংগঠনিক অবস্থান হারিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া না হলেও তার নামে দলের কোনো বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
ওবায়দুল কাদেরের দাপটে দলের মধ্যে কথাও বলতে পারতেন না অন্যান্য নেতারা। এনিয়ে অনেক কথা হলেও কান দিতেন না তিনি। পাঁচই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দলের সাধারণ সম্পাদকের অবস্থান জানার চেষ্টা করলেও, এখন আর করছেন না। কারণ, তারা মনে করছেন ওবায়দুল কাদের জন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিনাশ ঘটেছে। তাদের ভাষায় দলের বারোটা বাজিয়েছেন তিনি।
পাঁচই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা হয় লাপাত্তা, না হয় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাসে। রাজনীতির মাঠেও নির্বাসিত আওয়ামী আলী। এই অবস্থায় দলের নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরই হাল ধরবেন, দিবেন দিক নির্দেশনা। কিন্তু সীমাহীন অপকর্ম আর দুর্নীতির কারণে জনরোষ এড়াতেই গা ঢাকা দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
এই পরিস্থিতিতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ওপর ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন, ওবায়দুল কাদেরের কারণে দলের ভেতরে-বাইরে সব পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। শুধু মূল দলেই নয়, সহযোগী সংগঠনগুলোতেও দলের বিপদে পাশে থাকা না থাকা নিয়ে চলছে নানান আলোচনা। দলের এমন চরম সংকটের সময় কাদেরের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট খোদ দলের সিনিয়র নেতাকর্মীরাই।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই, নানা ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করে ব্যক্তি ওবায়দুল কাদেরের দিকে আঙুল তুলছেন। তাদের দাবি, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বড় দায় তার ঘাড়ে চাপে। সংগঠনে তিনি নিজেকে ‘একক কর্তৃত্বের’ জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ওবায়দুল কাদের আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। নেতাকর্মীর সঙ্গে দেখা হলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতেই বিচ্ছিন্ন তিনি।
আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওবায়দুল কাদেরের প্রশ্রয় পাওয়া নেতাদের দুর্ব্যবহারও ছিল সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো। তারা সুযোগ পেলে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য, সাবেক সিনিয়র এমপির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। এ কারণে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় ও সভাপতির কার্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই দলের তরুণ নেতাদেরও। তিনি পারতপক্ষে কারও ফোন রিসিভ করতেন না। দেখা করতে গেলে দেখাও করতেন না। সামনে গেলে দুর্ব্যবহার ছিলো অনিবার্য। ফলে নেতাকর্মীর সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েছিলো। ফলে সরকার পতনের পর ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান হারিয়েছেন- এমনটাই দাবি করছেন দলের তরুণ নেতাকর্মীরা।
তারা বলছেন, সাধারণ সম্পাদকই হলো দলের মুখপাত্র। তিনিই সাংগঠনিক বিবৃতি দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর ওই পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন দলের জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুবউল-আলম হানিফ এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নামে বিবৃতি যাচ্ছে। দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগে তো বটেই, রাজনীতিবিদ হিসাবে মৃত্যু হয়েছে ওবায়দুল কাদেরের।